দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিতর্কিত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদতদাতা, দ্ব›দ্ব-কোন্দলে জড়িত এবং বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী মতাদর্শীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এমপি-মন্ত্রীদের লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ইত্তেফাক অনলাইন
ইতিমধ্যেই নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠ জরিপের কাজ শুরু করেছে দলটি। আর এ গোপন মাঠ জরিপের কাজ স্বয়ং মনিটরিং করছেন দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় সভানেত্রীর নিজস্ব জরিপ টিম ও বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে প্রতি তিন মাস পরপর জরিপ রিপোর্ট আপডেট করা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের শতাধিক মন্ত্রী-এমপির কপাল পুড়তে পারে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে না আসার কথা মুখে বললেও শেষ পর্যন্ত দলের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ এবং দেশ-বিদেশে সবার কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হোক, সেটাও প্রত্যাশা দলটির হাইকমান্ডের। আর সেই কারণে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম ঝুঁকি নেবে না আওয়ামী লীগ। রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তি ইমেজ দিয়ে পরাজিত করতে পারে, এমন যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের হাতেই এবার নৌকা প্রতীক তুলে দিতে চায় দলটি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের সব সংসদ সদস্যের আমলনামা এখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতে। গত টানা তিন মেয়াদে মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনি এলাকায় কতটা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলের ভেতর উপদল সৃষ্টি-মাইম্যান তৈরি করেছেন, বিতর্কিত-জনবিচ্ছিন্ন কিংবা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদত দিয়েছেন এবং প্রভাব খাটিয়ে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পারিবারিক বলয় তৈরি করা, নিজ দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে নির্যাতন এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী-এমপিদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের পুরো আমলনামা রয়েছে দলীয় প্রধানের হাতে। এসব বিতর্কিতকে বাদ দিয়ে জনপ্রিয়-ত্যাগী এবং বিজয়ী হওয়ার মতো প্রার্থীদের এবার দলীয় প্রতীক নৌকা তুলে দেবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। গত ৭ মে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং। সেই কারণে দলের প্রার্থী বাছাইয়ে সারা দেশে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতারাই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাবেন।
দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন বেশ কয়জন মন্ত্রী-এমপি যে বাদ পড়বেন, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে অনেক দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংগঠনবিরোধী নানামুখী অভিযোগ জমা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, ‘এমপি বলয়’ সৃষ্টি, বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টির বিস্তর অভিযোগ জমা রয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারাও অনেকের বিরুদ্ধে নানামুখী অভিযোগ জমা দিয়েছেন। অভিযোগগুলো সত্যতা নিরূপণে গোপনে মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজও শুরু হয়েছে। এতে করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ফেঁসে যেতে পারেন দলের অনেক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য-মন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পাঁচ জন নেতা জানান, দলের মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনি এলাকায় কে কী করছেন, সবই রয়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নখদর্পণে। সবার আমলনামা নেত্রীর কাছে আছে। বারবার মাঠ জরিপ করে তিনি আমলনামা নিচ্ছেন। সেই আমালনামা অনুসারে কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে কেউ রেহাই পাবেন না। তিনি যত বড় নেতাই হন, আর যত বড় যে-ই হন। দলকে নির্বাচনমুখী করে তুলতে তৃণমূলে সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দল গুছিয়ে নতুন উদ্যমে আগামী নির্বাচনে টানা চতুর্থ বারের জনগণের মন জয় করে বিজয় আনতে চায় দলটি। তাই দলের দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত, দলীয় কোন্দলে জড়িত নেতা-মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে সৎ, ত্যাগী ও দক্ষ নেতাদের নিয়ে দল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে আরো সুসংগঠিত ও গ্রহণযোগ্য করতে চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কোন্দল, বিভেদ-বিভাজন ভেঙে দিতে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। নেত্রীর নির্দেশনার পর বসে নেই দলটির বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তারা তৃণমূলে মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিতর্কিত ও অজনপ্রিয়দের বাদ দিয়ে দলের দুর্দিনের পরীক্ষিতদের দায়িত্বশীল পদ-পদবিতে নিয়ে আসছেন। দলের অভ্যন্তরে সুযোগসন্ধানী ও অনুপ্রবেশকারীদের ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। যাদের কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে; তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের টার্গেট শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসা।
আওয়ামী লীগের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই ধরনের প্রার্থী তালিকা তৈরি করছে দলটি। বিএনপি নির্বাচনে এলে ১৪ দলীয় জোটের ব্যানারেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন তারা। পাশাপাশি মহাজোটের নামে না হলেও সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গেও অঘোষিত সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগি করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে জোটের শরিকদের কোনো কোনো আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে, সেসব আসনে জোটের প্রার্থীদের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো পরিবেশ রয়েছে কি না এসবও গোপন জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে প্রার্থীতালিকা তৈরি করছে আওয়ামী লীগ।