ডেস্ক রিপোর্ট: ঘরের আলমারির ওপর উঠে আড়ার সঙ্গে ফাঁস দেওয়ার অভিনয় করে টিকটক ভিডিও তৈরি করছিল ১১ বছরের কিশোরী সানজিদা আক্তার। কিন্তু পা পিছলে গলায় ফাঁস লেগে যায় তার। তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। ঘটনাটি গত ৮ জুলাইয়ের। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার শিবপুর গ্রামের মঞ্জুরুল ইসলামের মেয়ে সানজিদা। সে শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত।
শুধু সানজিদা নয়, গত এক বছরে এমন ১০ কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকটক বানানোর যে ভয়ংকর নেশা কিশোরদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেটা এখনই বন্ধ করা দরকার। ভাইরাল হওয়া এখন আমাদের মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, টিকটক বাংলাদেশের লাইসেন্সধারী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করলেও সরকার এই প্ল্যাটফরম থেকে কোনো প্রকার রাজস্ব পায় না।
সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘গতকালই (বুধবার) আমার ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ওরা এক জন বাংলাদেশিকে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ওদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার একটা চেষ্টা আমরা করেছিলাম। কিন্তু ওরা জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ওরা কোনো রেভিনিউ কালেক্ট করে না। যদি কখনো শুরু করে, তাহলে তারা এখানে নিবন্ধিত হবে। আগামী ২৬ জুলাই টিকটক কর্তৃপক্ষ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। ওদের একটা টিম এই বৈঠক করার জন্য এখানে আসছে।’
গত ৭ জুলাই দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল ছয় বন্ধু। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার একটি সড়কে টিকটকের জন্য মোটরসাইকেল চালানোর দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিল তারা। এ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরসাইকেল সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আহত তিন জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত্যু হয় ১৫ বছরের কিশোর আফিফ হোসেনের। নিহত আফিফ তাহেরপুর শহরের কোয়ালীপাড়া গ্রামের আবদুল হান্নানের ছেলে। সে জামগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
গত ১২ জুলাই কুমিল্লায় চলন্ত ট্রেনের ছাদে টিকটক করতে গিয়ে পা পিছলে ১৫ বছরের কিশোর মেহেদী হাসানের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে টিকটক ভিডিও আপলোডকে কেন্দ্র করে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত খুন হয়। গত ২ মার্চ রাজবাড়ী জেলার কালোখালী উপজেলায় টিকটক করতে গিয়ে হোসেন নামে ১৬ বছরের কিশোর রেল ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে টিকটক বানাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে রেলের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়। ৮ মে নড়াইলের কালিয়ায় টিকটক করতে বাধা দেওয়ায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করে সুমি আক্তার (১৯)। ১৬ মে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার শহরের লাল ব্রিজের অদূরে হৃদয় (১৫) নামে এক কিশোর খুলনাগামী নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে টিকটক বানাতে গিয়ে কাটা পড়ে মারা যায়। ২২ মে নীলফামারীর সৈয়দপুরে টিকটক করতে গিয়ে নদীতে ডুবে মৃত্যু হয় মুস্তাকিম ইসলাম (১৬) নামে এক কিশোরের। গত ২০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে নির্মাণাধীন তিন তলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে অনিল (১৪) নামে এক কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের টিকটক বানানোর প্রলোভনে ভারতে তরুণী পাচার করা হয়েছিল। গত বছরের জুন মাসে টিকটকের ফাঁদে ফেলে এক তরুণীকেও ধর্ষণ করা হয়। এছাড়া পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে তার অন্যতম কারণ টিকটক। কিন্তু বাংলাদেশে টিকটকের কোনো লাইসেন্স না থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। ফলে এই প্রতিষ্ঠানটিকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনার দাবি উঠেছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভির হাসান জোহা ইত্তেফাককে বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যম এখন আমাদের কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। আমরা এখন স্ত্রীর সঙ্গে শুয়ে থাকলেও লাইভ করছি। এসব কারণে আমাদের ইলেকট্রনিক মানসিক স্বাস্থ্যের ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। এদিকে এখন মনোযোগ দিতে হবে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন স্কুল কলেজে এটা পড়ানো শুরু করেছে। আমাদের পাঠ্যবইয়ে এখন এগুলো ঢোকাতে হবে। না হলে সামনে অরো কঠিন সময় আসছে।’ সূত্র: ইত্তেফাক