বঙ্গবন্ধুকে তার বাড়ির ভেতরে নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝামাঝি বাঁকে দণ্ডায়মান অবস্থায় মেজর নূর ও রিসালদার মোসলেম উদ্দীন তাঁর বুকের ডান দিকের একটু নিচে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ব্রাশ ফায়ার করার পূর্বমুহূর্তে মেজর ডালিম ও মেজর নূরের সাথে তার কথা চলছিল। মেজর ডালিম তাকে বলছিল যে, ‘আপনাকে আমরা বিচার করার জন্য চোখ বেঁধে ও হাত বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাব।’ বঙ্গবন্ধু বলছিলেন :‘কোথায় আমাকে নিয়ে যেতে চাস তোরা? সেজন্য আমার চোখ বাঁধবি তোরা? আমার হাত বাঁধবি তোরা? জানিস, ২৫শে মার্চ পাক সেনারা এই বাড়ি থেকে আমাকে সসম্মানে নিয়ে গেছে। তারা আমার চোখ বাঁধার কথা বলার সাহস পায়নি। পাক সেনাদের মেজর বেলাল আমাকে স্যালুট দিয়ে তার জিপের সামনে বসিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। আর তোরা আমার চোখ, হাত-পা বাঁধতে চাস? কেন রে? আমি কি মৃত্যুকে ভয় পাই? তোদেরকে ভয় পাই? আমি আমার হাতে গড়া আমার বাঙালি আর্মিকে ভয় পাই?’
শান্ত-মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক জনাব আকবর ১৫ই আগস্টের রাতের শেষ মুহূর্তের মর্মান্তিক সেই ঘটনার বিষয়ে খুনি হুদার জবানি উদ্ধৃত করে আমাকে সাক্ষাৎকার দেন গুলশানের ৮৪ নম্বর রোডে। কর্নেল রশিদ-ফারুক-ডালিমরা তাদের কমান্ডের সৈনিকদের কুর্মিটোলা নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে নিয়ে ডাহা মিথ্যা কথা বলে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেখানে চাকরীচ্যুত ১৬ জন সামরিক অফিসারসহ কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিম, ক্যাপটেন মহিউদ্দিনদের উপস্থিতিতে কর্নেল রশিদ চিৎকার করে বলে ওঠে : ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে আমাদের সেনাবাহিনীর সকলকে জীবন দিতে হলেও দিতে হবে। আজ শেষ রাতে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টারে এসে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে হাইজ্যাক করে তুলে নিয়ে যাবে। তারা চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের সীমান্তের কয়েকটি জেলা ভারতের অংশ বলে তার কাছ থেকে লিখে নেবে। আসুন, আমরা ছুটে যাই। যে কোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাই। বাংলাদেশকে বাঁচাই।’
এই জলজ্যান্ত মিথ্যা আহ্বানের মাধ্যমে তারা তাদের ফোর্সকে বিভ্রান্ত করে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এক যুগের বেশি সময় ধরে কর্মরত কাজের ছেলে সেলিম (আব্দুল) আহত হয়। সে ঐ মুহূর্তের সকল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ১৫ই আগস্ট রাতে যখন সিমারের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সিঁড়ির ওপর ফেলে গুলি করতে করতে ওপরে উঠে আসে, তখন এই সেলিমও (আব্দুল) তাদের গুলিতে ঊরুতে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। মাননীয় নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সাবেক পিএস আবু জাহিদ সেন্টু সাহেব তার সাক্ষাৎকার গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাকে জানালেন। আমি তাকে ৬৪ গুলশান অ্যাভিনিউয়ে আমার সরকারি বাসায় এনে এক সাক্ষাৎকার নিলাম।
আব্দুলের ভাষায়—‘‘উনি (বঙ্গবন্ধু) একবার নিচে গিয়ে ওপরে উঠে আসেন। তখনো তারা বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি। চারিদিক দিয়ে শত শত গুলি আসছিল। বঙ্গবন্ধু তার শোবার ঘরে ঢুকে রেড টেলিফোনে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলছিলেন। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তারা ওপরে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুর ঘরে ঢুকে তাকে টানাটানি করে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ও মারতে মারতে বের করে নিয়ে যেতে থাকে। তাদের হাতের রাইফেলের বাঁট এবং স্টেনগান দিয়ে ঘাড়ে ও পিঠে জোরে জোরে আঘাত করছিল। ঐ শয়তানরা বঙ্গবন্ধুকে পাঞ্জাবি পরতেও দিচ্ছিল না। ছয়-সাত জন দুহাত ধরে ধাক্কাধাক্কি ও টানাটানি করে নিয়ে যাচ্ছিল।…উনি শুধু বারবার বলছিলেন, ‘এই তোরা আমার সাথে বেয়াদবি করছিস কেন? বেয়াদবি করিস কেন? আমি কি তোদের জন্য কিছু করিনি? এই দেশের জন্য কিছু করিনি?’…ব্রাশ ফায়ারের সাথে সাথে খালাম্মা (ফজিলাতুন নেছা মুজিব) দৌড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেলেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ, আমাকেও মেরে ফেলো, আমাকেও মেরে ফেলো। আমাকে মেরে ফেলো।’ আবার ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনলাম। খালাম্মাকেও ওরা মেরে ফেলল।’’
বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরে সকাল ৮টায় কর্নেল রশিদ ৩২ নম্বর বাড়িতে এসে বঙ্গবন্ধুর হাত-পায়ের রগ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জওয়ানদের দিয়ে কাটায়! বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে ফেলে মন্ত্রী হয়েছে। যেসব মন্ত্রী দিবস-রজনি ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু’ নামজপ করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলত, তারা বঙ্গভবনে এসে খুনিদের বুকে জড়িয়ে ধরেছে।
১৫ই আগস্ট সকালে বঙ্গভবনে ঢুকেই আমি প্রেসিডেন্টের এপিএস আব্দুল মান্নানকে বললাম যে, মুখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস মামাকে আমি ভোরে পৌনে ৭টায় লন্ডনে ফোন করি। তখন ওভারসিজ ট্রাংককল সুপারভাইজারের ফোন নম্বর ছিল : ২৪২৭২৯। সেই ফোনে ফোন করে সুপারভাইজার সাহেবকে বঙ্গভবনের কথা বলে আমি এক মিনিটের মধ্যে কানেকশন দিতে বললাম। টেলিফোন ধরে সঙ্গে সঙ্গেই মামার কানেকশন পেয়ে গেলাম। মামা আমাকে বললেন, ‘সিজিএস খালেদ মোশাররফের সাথে ভোরে আমার কথা হয়ে গেছে। সে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। রক্ষীবাহিনীকে যে কোনো উপায়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য আমি তাকে বলে দিয়েছি। এসপি মাহবুবকে ঢাকার থানাগুলোর ওসি এবং পুলিশদের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছি। তোমরা এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা সিজিএসের সাথে কো-অর্ডিনেট করো। আমি কয়েক জন সচিবকে বলে দিয়েছি, বঙ্গভবনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বর্জন করার জন্য।’ ১৫ই আগস্ট সিজিএস খালেদ মোশাররফ স্যারের সিওডি (কোঅর্ডিনেশন অফিসার) মেজর হোসেনের সঙ্গে সকাল ৯টায় আমার যোগাযোগ হয়। তিনিও আমাকে বললেন, সিজিএস স্যার আপনাকে বলতে বলেছেন, বঙ্গভবনের সকল অফিসার যেন বের হয়ে যান এবং কেউ যেন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির না থাকেন। অধিকাংশ সিএসপি সচিব আমাকে বললেন, তারা আসবেন না। শুধু একজন সচিব কুমিল্লার সাত্তার সাহেব আমাকে ধমক দিলেন এবং বললেন, ‘এখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিপ্লব হয়ে গেছে। তোমার মামার রেফারেন্সে আর কিছু বোলো না। বাঁচতে চাইলে বঙ্গভবন ছেড়ে তুমি চলে যাও।’
বঙ্গভবনে খুনি মোশতাকের শপথ গ্রহণ হয় দুপুরে। মন্ত্রীদের হয় বিকেলে। খুনি মোশতাকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমি, আমার সহকর্মী রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, কুমার শংকর হাজরা, আলী তারেক, গাজী মনসুর, ফরিদ উদ্দিন আহমদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলাম। সেখানে কেবিনেট সেক্রেটারি এইচ টি ইমাম সকলকে বসাচ্ছিলেন এবং আগত সকলকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে পরিচয় করে দিচ্ছিলেন। ১৬ই আগস্টের দৈনিক ইত্তেফাকসহ অন্যান্য পত্রিকায় যেসব ছবি বেরিয়েছে তাতেও দেখা যায় যে খুনি মোশতাকের ডান দিকে দাঁড়িয়ে এইচ টি ইমাম নামাজ পড়ছেন। বঙ্গভবনের অন্যান্য অনুষ্ঠানের ছবিতেও খুনি মোশতাকের ডান দিকে তাকে দেখা যায় (১৬ই আগস্ট ১৯৭৫-এর ইত্তেফাকের ছবি। জাতীয়করণ করায় এ সময় দৈনিক ইত্তেফাক সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো)।
বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে একজন মাত্র মহিলা উপস্থিত ছিলেন। তিনি মোশতাকের আত্মীয়, যিনি কর্নেল রশিদের স্ত্রী। তিনি অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে উপবিষ্ট ছিলেন। কর্নেল রশিদ ও কেবিনেট সেক্রেটারি আগত বিভিন্ন অতিথিকে নিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছিলেন। স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় কর্নেল রশিদ বলছিলেন, ‘আমার স্ত্রী আজকের বিপ্লবের ও বিজয়ের মূল পরিকল্পনাকারী।’ ১৫ই আগস্ট দুপুরে বঙ্গভবনে খুনি খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন তিন জন—মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম এবং স্বঘোষিত মুখ্য সচিব মাহবুব-উল-আলম চাষী। কেবিনেট সেক্রেটারি মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ দুর্ব্যবহার করেছিলেন, যাতে মন্ত্রীরা সবাই খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে শপথ নেন এবং সচিবরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের মান-মর্যাদা ও শ্রীবৃদ্ধি করেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী ফণি বাবু কাঁদছিলেন ও ঝরঝর করে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। বারবার তিনি চোখ মুছছিলেন। আমি তার পাশে গিয়ে বললাম, ‘ফণিদা, কাঁদছেন তাহলে আসলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘গত তিন-চার দিন অসুস্থ অবস্থায় আমি পিজি হাসপাতালে ছিলাম। আমাকে সেখান থেকে লাথি মারতে মারতে আর্মি জওয়ানরা ট্রাকে তুলে বুকের ওপর পা চাপা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।’ কোথা থেকে ছুটে এসে কেবিনেট সেক্রেটারি ফণি বাবুকে ধমকিয়ে বললেন, ‘এখানে কোনো সিন ক্রিয়েট করবেন না। ডোন্ট ক্রাই লাইক আ গার্ল হেয়ার। এরা আপনাকে এখুনি বঙ্গভবনের মাঠে ফেলে গুলি করে মেরে ফেলবে।’ তার কথা শুনে ফণিদা আমাকে বললেন, ‘মুসা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করে জেল-জুলুম খাটলাম। বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে জেল-জুলুম খাটলাম। আর এখানে বেতনভুক্ত কর্মচারী আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখায়। গো অ্যান্ড টেল হিম আই অ্যাম নট অ্যাফরেড অব ডেইথ।’
১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমরা বঙ্গভবনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। আমি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে সিজিএস জেনারেল খালেদ মোশাররফ স্যারের প্রিয় ছিলাম। সে কারণে আমি তাকে টেলিফোনে ধরার মুহুর্মুহু চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার সিওডি মেজর হোসেন আমাকে টেলিফোন করলেন। বললেন, সিজিএস স্যার আপনাকে জরুরি মেসেজ দিয়েছেন। মেসেজটি হলো, ‘আপনারা বঙ্গভবন থেকে সব সিভিল অফিসার ভেগে যান। যাতে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যাকে প্রেসিডেন্ট করে শপথ অনুষ্ঠান করাবে, সে অনুষ্ঠানে যেন কোনো সিভিল অফিসার না থাকেন। বহির্বিশ্বকে তারা যেন দেখাতে না পারে যে, সিভিল অফিসাররাও খুনিদের সমর্থন করেছেন।’ তার সঙ্গে কথা বলামাত্র আমি বঙ্গভবনের সব অফিসারকে পালাতে বললাম। আমাদের কথা শুনে বেশির ভাগ স্টাফ ক্ষিপ্রগতিতে বঙ্গভবন থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমাকে এসব বলতে দেখে প্রেসিডেন্টের এপিএস আব্দুল মান্নান আমাকে এক পাশে টেনে নিয়ে বললেন, ‘মুসা ভাই, আপনি তো মারা পড়বেন।’
লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট, ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে কর্মরত সাবেক সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ও সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
(বি. দ্র.—লেখক যা লিখেছেন আমরা তা হুবহু প্রকাশ করলাম। এসব ঘটনা ও উদ্ধৃতি তাত্ক্ষণিকভাবে যাচাই করার কোনো সুযোগ ছিল না। —বি.স.)