লুটপাটের আরেক আখড়া পৌরসভা

মানিকগঞ্জ পৌরসভার সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে মাত্র ছয়টি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে। এগুলো হচ্ছে- সুইপার, সুইপার সুপারভাইজার, কেয়ারটেকার, মৌলভী, পুরোহিত ও ডোম। কিন্তু সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৪৮ জন অস্থায়ী কর্মচারীকে। অর্থাৎ প্রয়োজনের ৪১ গুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাসে জনপ্রতি ৬ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হলে ৩৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হতো। অথচ এখন পৌরসভাকে এ খাতে ব্যয় করতে হচ্ছে ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। প্রায় একই চিত্র নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভায়। সেখানে আউটসোর্সিংয়ে কাজ করছেন ৪২২ জন কর্মচারী। তাদের বেতন-ভাতাও যথারীতি পরিশোধ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কাগজে-কলমে ৪২২ জন দেখানো হলেও বাস্তবে কাজ করছে কমবেশি ১০০ কর্মচারী। বাকিদের বেতন-ভাতার টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ২২ আগস্ট মানিকগঞ্জ পৌরসভার চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীর নাম, পদবি, কোন শাখায় কাজ করে, কবে থেকে নিয়োগ হয়েছে এবং তার মাসিক ভাতা কত, তা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। পাশাপাশি অনুমোদিত ছয়টি পদ ছাড়া অন্যান্য পদে নিয়োগকৃত অস্থায়ী কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সৈয়দপুর পৌরসভার আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত ৪২২ কর্মচারীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর, পদ, নিয়োগের তারিখসহ বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। এক মাস পার হলেও অদ্যাবদি এ সংক্রান্ত তথ্য দেয়নি ওই পৌরসভা। এ ছাড়া সম্প্রতি ‘খ’ ও ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভার জনবল সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে মেয়রদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
জানা গেছে, কোনো পৌরসভার বার্ষিক রাজস্ব আয় পরপর তিন বছর গড়ে ১ কোটি টাকার বেশি হলে সেটি প্রথম বা ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা। একইভাবে পরপর তিন বছর গড় রাজস্ব ৮০ লাখ টাকার বেশি হলে সেটি দ্বিতীয় বা ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভা। প্রতি বছরে গড় রাজস্ব আয় ৬০ লাখ টাকার বেশি হলে তা তৃতীয় বা ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভা। বর্তমানে দেশে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি মিলিয়ে পৌরসভা রয়েছে ৩২৮টি। এর মধ্যে ৩৪টি পৌরসভায় এক বছর থেকে ৪৭ মাস পর্যন্ত কর্মীদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে। ১০০-এর বেশি পৌরসভায় কর্মীদের বকেয়া বেতন-ভাতার পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা। পৌরসভাগুলোতে বর্তমানে স্থায়ী কর্মী রয়েছেন ১১ হাজার ৬৭৫ জন। আর অস্থায়ী বা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন এমন কর্মীর সংখ্যা ২০ হাজার ৩৫৫। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পৌরসভাগুলোতে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ বন্ধ করতে বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। মেয়ররা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন। আউটসোর্সিং বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৪১ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া। অথচ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন না দিয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পৌরসভার রাজস্ব দ্বারা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছেন মেয়র। হাট-বাজারের ইজারার টাকাও সময়মতো খাতওয়ারী বণ্টন হয় না। এমনকি এসব টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। এ বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে পৌর মেয়রকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হলেও গত ছয় মাসেও জবাব মেলেনি। গত ১০ আগস্ট এ বিষয়ে তাগিদপত্র দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ বলেছে, সময়মতো জবাব না পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন চিত্র দেশের অধিকাংশ পৌরসভার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র শেখ নুরুন্নবী অপু বলেন, ‘অধিকাংশ পৌরসভার আয় নানা খাত, উপখাত দেখিয়ে লুটপাট হয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে পৌরসভা পরিচালনা করলে কারও বেতন-ভাতা বকেয়া থাকার কথা নয়।’ তিনি আরও জানান, তার পৌরসভার বার্ষিক আয় ১ কোটি টাকারও বেশি। তারপরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৩ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে। বিদ্যুৎ বিল ১৪ লাখ টাকা, জ্বালানি তেলের ৬ লাখ টাকা, ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য খাতে ৪ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। অস্থায়ী ৪২ জন কর্মচারী থাকলেও স্থানীয় ইউএনও প্রশাসক থাকাকালীন তাদের ছাঁটাই করেছেন। আগের মেয়রের এসব বকেয়া এখন তাকে টানতে হবে।
তবে কোনো কোনো পৌরসভায় নিজস্ব আয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। বাড়ানো হচ্ছে পৌরসভার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও। জামালপুরের ইসলামপুর পৌরসভায় মেয়রের দায়িত্বে আছেন মো. আবদুল কাদের সেখ। টানা তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পালনকারী এ মেয়র বলেন, ‘আমার পৌরসভার বার্ষিক আয় ২ কোটি টাকার ওপরে। কোনো বেতন-ভাতা বকেয়া নেই। বরং পৌরসভার আয় দিয়ে পৌর এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকা চলছে। নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
এমন পরিস্থিতিতে পৌরসভাগুলোর শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। পৌরসভাগুলোর আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গত ১১ এপ্রিল পৌরসভা আইনে সংশোধনী আনা হয়। সে অনুযায়ী কোনো পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১২ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া থাকলে সরকার সেই পৌরসভার নির্বাচিত পরিষদ ভেঙে দিতে পারবে। অর্থাৎ সেই পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হবে। পাশাপাশি পৌরসভাগুলোকে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। পৌরসভাগুলো আয় বাড়াতে না পারলে সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। এ ছাড়া অস্থায়ী পদে লোক নিয়োগ, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি বেতন-ভাতা পরিশোধ না হলে কোনো মেয়র বিদেশে প্রশিক্ষণে যেতে পারবে না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় ৩৮টি পৌরসভা নিজ আয়ে বেতন-ভাতা দিতে পারত। তাদের বলে দেওয়া হয়েছে পৌরসভাগুলো আয় বাড়াতে না পারলে সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেবে। এটা ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে। এখন প্রায় ৩০০ পৌরসভা স্বআয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে। ৩০ থেকে ৩৫টি পৌরসভা এখনো বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না। আশা করছি, শিগগিরই সব পৌরসভা নিজেদের আয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারবে।’

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

Md.Iqbal Hossain

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *