ঘণ্টায় হাসপাতালে ২০ ডেঙ্গুরোগী

দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। একইসঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকা। বাড়ছে আতঙ্ক আর ভয়। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় গুরুত্ব দিতে ইতোমধ্যেই দেশের সব হাসপাতালকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে গতকাল রাতে প্রাইম টিভিকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, কোনো ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে গেলে তাকে যেন ফিরিয়ে না দেওয়া হয় সে বিষয়ে সব হাসপাতালকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সম্প্রতি এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটির ১২ শতাংশ বাসাবাড়িতে ডেঙ্গু ছড়ানো এডিস মশার বিস্তার রয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহর ও নগর-মহানগরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ড্রেনে গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়েছে, যা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। এছাড়াও লার্ভা ধ্বংসে প্রজননস্থলের পানিতে মেশানো হচ্ছে নোভাল নিউরন ট্যাবলেট।

ঘণ্টায় হাসপাতালে ২০ ডেঙ্গুরোগী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে মাইকিং করে ডেঙ্গু মশার লার্ভা (উৎস স্থল) ধ্বংসে উদ্বুদ্ধ করাসহ করণীয় সম্পর্কে জানাতে হবে। ডেঙ্গু ছড়ানো ‘এডিস মশা’ নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে যে পদক্ষেপ বা কর্মসূচি চালানো হচ্ছে তা কোনো কাজে আসছে না। এসব পদক্ষেপ বা কর্মসূচি বিশ্লেষণ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে টেকসই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাথ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এ সময়ে সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৬২ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ১১ হাজার ৭১ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ৩ হাজার ২৯১ জন। গত রবিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৮২ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সে হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গড়ে ২০ জন ডেঙ্গু রোগী। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৪৪০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সে হিসেবে ওই ২৪ ঘণ্টার প্রতি ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হন গড়ে ১৮ জন ডেঙ্গু রোগী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫১ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। তবে ৪০ জেলায় ডেঙ্গুর স্থানীয় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক জেলায় যদি পুরো বছর পাঁচজন রোগী পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, আক্রান্ত রোগী অন্য জেলা থেকে এসেছে। তবে এর বেশি হলে ধরে নেওয়া হয় ডেঙ্গু স্থানীয়ভাবে ছড়িয়েছে। সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুর স্থানীয় সংক্রমণ এরই মধ্যে ৪০ জেলায় দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, ডেঙ্গু মোকাবিলা করা কঠিন হবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের করা যৌথ এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ড এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির ১৩টি আর দক্ষিণ সিটির ১৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। এসব এলাকার ১২ ভাগ বাসা-বাড়িতেই এডিস মশার বিস্তার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, ঢাকা শহরের ২ হাজার ৭৫৮টি বাসা পরিদর্শন করে ৩৯২টিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। শতকরা হারে এটি ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এরমধ্যে ৬৩টি ঢাকা উত্তর সিটির ৯৬টি বাড়ি ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে অবস্থিত।’

ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুই সিটিতে পড়ে থাকা বা ফেলে রাখা ভেজা পাত্রে সবচেয়ে বেশি ২১ দশমিক ৬১ শতাংশ মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এছাড়াও ঘর বা ভবনের মেঝে প্লাস্টিকের ড্রাম বা প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্রেও এই লার্ভা পাওয়া যায়। ঢাকা দক্ষিণ করপোরেশনের ২৬ শতাংশ এ ধরনের পাত্রে ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২২ শতাংশ পাত্রে মশার এই লার্ভা পাওয়া গেছে। মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ৮ নম্বর ওয়ার্ড (কমলাপুর ও মতিঝিল), ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড (নবাবপুর ও বংশাল) এবং ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে (ওয়ারী ও নারিন্দা)। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর ২৭ জন ঢাকার বাইরের। এর আগে ২০১৯ সালে দেশে এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সরকারি হিসাবে ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। মাঝে এক বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম থাকলেও ২০২১ সালে ফের ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু ছড়ায়। তাতে ২৮ হাজার ৪২৯ জন এ রোগ নিয়ে হাসপাতালে যান, মৃত্যু হয় ১০৫ জনের।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত সাতটিতে ১ হাজার ৭৯৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ জন কক্সবাজারের। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার সবক’টিতেই এবার ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে যশোর ও নড়াইলে। ঝালকাঠি বাদে বরিশাল বিভাগের সব জেলায় এ বছর ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে ছয়টিতে এ পর্যন্ত ১৭১ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এ বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পাবনা জেলা। ময়নসিংহ বিভাগের চার জেলার সবক’টিতেই ডেঙ্গু আক্রান্তত রোগী পাওয়া গেছে। এ বিভাগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২১১ জনের মধ্যে ১৫২ জনই ময়মনসিংহের। রংপুর বিভাগের রংপুর, লালমনিরহাট ও দিনাজপুরে এ পর্যন্ত ১৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সিলেট বিভাগের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় এ পর্যন্ত ২৭ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে মশা নিয়ে গবেষণা করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যপক ড. কবিরুল বাশার গতকাল রাতে প্রাইম টিভিকে বলেন, ডেঙ্গু এখন উদ্বেগের বিষয়। কোন কোন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি সেই হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানো দরকার। ফগিংয়ের মাধ্যমে (মশার ওষুধ ছিটানো) উড়ন্ত মশা মেরে ফেলতে হবে। নইলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে। তিনি বলেন, ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানো, মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করাসহ মাইকিং করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিচালিত কর্মসূচি যথাযথ নয় উল্লেখ করে ড. কবিরুল বলেন, ‘এতে কোনো কাজে আসছে না। এসব কর্মসূচিতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত মূল্যায়ন করে গবেষকদের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রধান কাজ। মশা নিধনে জাতীয় একটি সেল গঠনও জরুরি।’

কী পদক্ষেপ ঢাকার দুই সিটির

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, কয়েক বছর ধরে নগরবাসীকে সচেতন করার পাশাপাশি শাস্তির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। শাস্তি হিসেবে প্রধানত জরিমানা করা হচ্ছে, এমনকি গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গত সপ্তাহেও বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ড্রোনের মাধ্যমে ছাদবাগানগুলো দেখা হয়েছে। সেখানে পানি জমে আছে দেখা গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ভবনের বাইরে ড্রেন ও পানিতে ‘নোভাল নিউরন’ ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। যা তিন মাস পর্যন্ত এডিস লার্ভা জমতে দেয় না। এ ছাড়া গাপ্পি মাছ ছাড়া হচ্ছে, যেগুলো লার্ভা খেয়ে ফেলে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে

primetvbd_primetvbd

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *