হাকীম-কবিরাজ-ডাক্তার একই অর্থে সমাহার

ডা: আক্তার হোসেন
প্রভাষক (অনারারী), সার্জারী বিভাগ
সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিলেট

এক সময় চিকিৎসা সেবাদানকারীদের “কবিরাজ” বলা হত। এখনে কবি শব্দের অর্থ কবিতা রচয়িতা নয় ; কবি শব্দের অর্থ হলো সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী । এই সর্ব জ্ঞানের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তাদেরকে মৈথালী ভাষায় কবিরাজ বা মহাপন্ডিত বলা হত। সেই সময় বৌদ্ধরা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে পান্ডিত্য সূচক ”কবিরাজ ” উপাধি গ্রহণ করত। কালের পরিক্রমায় এই উপাধি আয়ুর্বেদ পন্ডিতগণ চিকিৎসকমাত্র অর্থে ব্যবহার করে আসছেন। বুৎপত্তিগত বা ঐতিহাসিক ভাবে। চিকিৎসকরা সমাজের পণ্ডিত শ্রেণী বা মেধাবী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন।

Doctor শব্দটি এসেছে Greek Doccre শব্দ থেকে Docere শব্দের অর্থ (knowledgeable person) জ্ঞানি ব্যক্তি। ”হাকীম” শব্দটি আরবী “হিকমত” শব্দ হতে উদ্ভূত। যার অর্থ বিজ্ঞানী বা কুশলী। কিন্তু ততকালীন ভারত উপমহাদেশের লোকজন চিকিৎসকদেরকে “হাকীম” শব্দ দিয়ে সম্বোধন করার পেছনে কারণ ছিল পূর্ণ আরবী ভাষা না জানা।
তারা বই পুস্তকে দেখেছে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ইবনে সীনা, আল রাজী গং বিজ্ঞানীগণকে আরবী “হাকীম” শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে। আর জনসাধারণের কাছে তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে বেশী পরিচিত অর্জন করেছিলেন । তাই পরবর্তী চিকিৎসকদেরও “হাকীম” শব্দ দিয়ে সম্মোধন করেছিল। ক্রমান্বয়ে এ শব্দটি গলদ মশহুর হয়ে যায়। কিন্তু একটি বারও কেউ চিন্তাই করেনি যে, এ মনীষীগণ শুধুমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানি ছিলেন না এবং একাধারে বেশ কয়েকটি বিষয়ের বিজ্ঞানী ছিলেন। যার কারণে তাদেরকে “জাকীমুত তিব্ব” সম্বোধন না করে ব্যাপক অর্থবোধক “হাকীম” শব্দ দিয়ে সম্ভোধন করা হয়েছিল। সাধারণ কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে যেমন বিজ্ঞানী বলা যায় না তেমনি সাধারণ চিকিৎসককেও চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলা যায় না।
এ উপমহাদেশে একাধারে কয়েকটি বিষয়ের কোন বিজ্ঞানী আছেন বলে জানা নেই। যে কয়জন বিজ্ঞানী আছেন, তারা একেকটি বিষয়ের বিজ্ঞানী। সুতরাং যে যেই বিষয়ের বিজ্ঞানী সেই বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করে “হাকীম” শব্দটি সংযোজন করা উচিত,

যেমন- চিকিৎসা বিজ্ঞানী কে সম্বোধন করা হোক “হাকীমুত তিব্ব” বলে, কৃষি বিজ্ঞানী কে সম্বোধন করা হোক ” হাকীমুয যারাই” চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে বিষয়ে যিনি বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন তাকেঁ সেই বিষয়ের পারদর্শী/হাযিক্ব বা বিশেষজ্ঞ বলা হয়ে থাকে, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানীর সংজ্ঞায় আসেন না

চিকিৎসক শব্দের আরবি অর্থ হচ্ছে “তাবীব” বর্তমানে আরবীতে দাকতুরও ব্যবহার হচ্ছে ।
সাধারণ কোন চিকিৎসক কে “হাকীমুত তিব্ব” বলা হাস্যকর।

আর “হাকীম” শব্দ দিয়ে কাউকে সম্বোধন করতে হলে নুন্যতম একাধিক বিষয়ের বিজ্ঞানী হতে হয়। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব পৃথিবীতে হাতে গোনা কয়েকজন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেকোন ভুল বিষয়ের ভুল স্বীকার করে তা সংশোধন করে নেয়াটাই দূরদর্শিতার পরিচায়কা।

সারা জীবন “ঢাকা” শব্দের ইংরেজি বানান ভুল লিখা হয়েছিল, কেউ তা টেরও পায়নি। পল্লীবন্ধু হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ হোসেইন সরকার সংশোধন করার পর কেউতো আর প্রতিবাদ করেনি। “হাকীম” শব্দটি কিন্তু সেকেলে নয় আর “ডাক্তার” শব্দটি মর্ডান ও না, উভয়টি ভিন্ন অর্থবোধক, দুটি পরিভাষা।

আরবী “তবীব” শব্দের সঠিক বাংলা হচ্ছে চিকিৎসক, আর বাংলা ভাষীরা চিকিৎসককে ডাক্তর (দাকতুর) বলে সম্বোধন করে থাকে। আর বিজ্ঞানীকে “হাকীম” বলে সম্বোধন করছেন। “বাংলাদেশ ইউনানী মেডিকেল এসোসিয়েশন” অনুবাদ করা হয়েছে আনজুমানে আতিব্বা বাংলাদেশ থেকে, এখানেও একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, এই সংগঠনটির জন্মলগ্নে “আনজুমানে হুকামা” না বলে “আনজুমানে আতিব্বা বাংলাদেশ ” বলা হচ্ছে। আরবী ভাষায় “তবীব” এবং ডাকতুর দুটি সমার্থক হলেও স্থান কালভেদে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন-বাংলা ভাষায় চিকিৎসক এবং “ডাক্তার” স্থান কাল ভেদে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কালের বিবর্তনে ভাষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন আসে,

যেমন- এই উপমহাদেশে মোঘল আমলে উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীদেরকে “মোল্লা” শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হত। পরবর্তিতে ইংরেজদের আমলে তারা পরিবর্তন করে “মৌলভী ” করা হয়। কালক্রমে তা শুধু মাদরাসা শিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আলেম-উলামাকে “মাওলানা” ও “আল্লামা” শব্দ নিয়ে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। সেই যুগের সর্বোচ্চ সম্মানী খেতাব “মোল্লা” শব্দটি আমাদের দেশে কিন্তু অবহেলিত হয়ে গেছে। বর্তমান সমাজে যারা ঝাড়-ফুঁক, তাবীজ,কবজ দিয়ে চিকিৎসা করে তাদেরকে “মোল্লা” সম্বোধনকরা হয়ে থাকে।

প্রকৃত কোন আলেমকে “মোল্লা” শব্দ দিয়ে সম্বোধন করা হয় না। আজ বাংলা ভাষায় যেভাবে নতুন নতুন শব্দ সংযোজন করা হচ্ছে আরব দেশে যেখানে সঠিক শব্দ তবীবের স্থলে তীরে “দাকতুর” ব্যবহার করা হচ্ছে।

সেখানে আমাদের দেশে পৃক্ত চিকিৎসককদের ভুল সম্বোলিত নামের পূর্বে ভুল সম্বোলিত “হাকিম” শব্দের স্থলে হলে মাতৃভাষা “ডাক্তার” লিখা বা সম্বোধন করা যুগোপযোগী ও সময়োচিত।

নামের শেষে যখন লিখা থাকবে “ডিইউএমএস” /”বিইউএমএস” তখন বুঝা যাবে তিনি একজন ইউনানী চিকিৎসক, ডিএএমএস/বিএএমএস- লিখলে বুঝায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক “ডিভিএম” লিখলে বুঝা যায় পশু চিকিৎসক, ডিএইচএমএস/ বিএইচএমএস লিখলে বুঝা যায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক বিপিটি লিখলে বুঝা যায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক। ডাঃ শুধুমাত্র এমবিবিএস বর্ণ বহনকারীদের কোন মৌরসী সম্পদ নয়। হামদর্দ দাওয়াখানা নাম পরিবর্তন করে হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ করা হয়েছে। কুরছ/ হাবৰ / শরবত পরিবর্তন করে যথাক্রমে ট্যাবলেট/পিল/ সিরাপ যদি লিখা যায়, তাহলে ইউনানী চিকিৎসকদের নামের পূর্বে সঠিক শব্দ “ডাক্তার (দাকতুর)” লিখতে সাধু সাবধানের সংকেত দেওয়াটা কি সাধুর পরিচয় নয়? এই সাধুতার পরিচয় দিতে সিলেট সরকারী ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ হতে উত্তীর্ণ ২৭ জন চিকিৎসক মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রীট পিটিশন ১৫৮০৫/২০১২ দায়ের করিলে দীর্ঘ শুনানী অন্তে কোর্ট “ডিইউএমএস সনদধারীদের নামের পূর্বে “ডাঃ” ব্যবহার করতে

Md Ismat Toha

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *